Thursday, June 7, 2012

তাপবিদ্যুত কেন্দ্র : সম্ভাবনা না সংকট

তাপবিদ্যুত কেন্দ্র : সম্ভাবনা না সংকট 

মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ (২৮জুন ২০১২):  বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবনের কাছে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ভারতের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগ চুক্তি (জয়েন্ট ভেঞ্চার এগ্রিমেন্ট-জেভিএ) করেছে সরকার। সরকারি পর্যায়ে ২টি দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ২টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এটাই প্রথম যৌথ বিনিয়োগের চুক্তি। অবশ্য আগে বেসরকারি খাতে এমন চুক্তি অনেক হয়েছে। আমরা জানি জ্বালানি সমস্যাই আমাদের প্রধান সমস্যা। সরকার জ্বালানির সংকট নিরসনে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে। আগে গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো। বর্তমানে জ্বালানি তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ কাজ শুরু হল। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এলাকার পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হবে বলে পরিবেশবিদরা মতামত দিয়েছেন। আমরা জানি সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীব-বৈচিত্র্য বাংলাদেশের একটি গর্ব। কিন্তু সরকার সুন্দরবনের পরিবেশগত দিক বিবেচনা না করে সেখানে কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করলে এর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বনের ওপর। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের গাছপালাসহ সব ধরনের জীব-বৈচিত্র্য  ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বলছে, সরকার পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে সুন্দরবনের মাত্র ৯ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে এই বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি বিরূপ প্রভাব পড়বে বনের গাছগাছালি, পশুপাখি, মাছসহ সব ধরনের জীব-বৈচিত্র্যের ওপর । বিদ্যুৎকেন্দ্রের  গরম পানি, কয়লা পোড়ানো ছাই ও কালো ধোঁয়া সুন্দরবনের সব জীব-বৈচিত্র্য ধ্বংস করে ফেলবে।বাপার প্রতিবেদনে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের উদ্বৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ৫০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে অন্তত ৩৭ লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড, ১০ হাজার টন সালফার ডাই-অক্সাইড, ১০ হাজার ২০০ টন নাইট্রোজেন অক্সাইড, ২২০ টন হাইড্রো কার্বন, ৭২০ টন কার্বন মনো-অক্সাইড, ১৭০ পাউন্ড পারদ, ২২৫ পাউন্ড আর্সেনিক, ১১৪ পাউন্ড সিসাসহ অন্যান্য বিপুল পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এ ছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপুল পরিমাণ ছাই ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ বাতাস, ভূ-পৃষ্ঠ ও ভূ-গর্ভস্থ পানি দূষণ করে। এসব দিক বিবেচনায় রেখে বাগেরহাট তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রে উপযুক্ত শোধনাগার না থাকলে তা বৃহত্তর সুন্দরবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। অন্যদিকে সরকার বলছে, সব ধরনের পরিবেশগত দিক রক্ষা করেই বাগেরহাটে ওই তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। এতে সুন্দরবনের জীব-বৈচিত্র্য ক্ষতি হওয়ার কোনো কারণ নেই। সরকারি এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, রামপালের কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রথম পর্যায়ে ৫০০-৬৬০ মেগাওয়াট করে দুই ইউনিটে ১,৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এ জন্য অধিগ্রহণ করা হবে প্রায় ১৮০০ একর জমি। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্রর কাজ সম্প্রসারণ করে উৎপাদন করা হবে আরো ১৩০০ মেগাওয়াট তাপবিদ্যুৎ। বিদ্যুৎ কেন্দ্রর জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হবে বড় পুকুরিয়ার কয়লা। এ কয়লা মংলা সমুদ্রবন্দর দিয়ে মালবাহী জাহাজে আনা-নেওয়া করা হবে।বাগেরহাটের পশুর নদের তীরে তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হলে এর বিষাক্ত কালো ধোঁয়া আচ্ছন্ন করে ফেলবে সুন্দরবন এলাকার নির্মল আকাশ। চিমনি দিয়ে উগরানো ছাই বিস্তীর্ণ এলাকার বাতাসে ভেসে ঘটাবে মারাত্মক দূষণ। কারখানাটির কার্বন, পারদ, সিসা, আর্সেনিকসহ নানা বর্জ্য সরাসরি দূষিত করবে নদীনালার পানিকে। ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ সুন্দরবনের সব সৌন্দর্য। একে একে সব গাছপালা মারা পড়বে ।শেষ হয়ে যাবে বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ বনের সব পশুপাখি, জলজ    প্রাণী ।
বাগেরহাটের রামপালের সংলগ্ন বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত সুন্দরবন। সুন্দরবনের কাছে এ ধরনের তাপ বিদ্যুৎ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হবে বলে মতামত দিলেও পিডিবির চেয়ারম্যান বলেছেন, এ কেন্দ্র পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো কিছুই হবে না। তিনি আরো বলেন, এ কেন্দ্র থেকে কয়লা পোড়ানোর ফলে যে অ্যাশ বেরুবে তা ক্যাপচার করার জন্য উচ্চ ক্ষমতার সরঞ্জাম ব্যবহার করা হবে। রামপালের কয়লাভিত্তিক এ কেন্দ্রটি খুলনা শহর থেকে ২৩ কিলোমিটার ও মংলা থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে। এমনকি সুন্দরবন থেকেও ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কেন্দ্রটি নির্মাণের জন্য ১ হাজার ৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। উভয় দেশের সমান মালিকানায় এ কেন্দ্রটির ২০১৫ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে আমদানি করা কয়লার মূল্য টন প্রতি ১০৫ মার্কিন ডলার হলে ইউনিট প্রতি দাম পড়বে ৫ টাকা ৯০ পয়সা। আর কয়লার দাম যদি ১৪৫ মার্কিন ডলার হয় তা হলে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম পড়বে ৮ টাকা ৮৫ পয়সা।
উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ সমস্যার জরুরি সমাধানে সরকার এর মধ্যে কয়েকটি কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে বেসরকারি খাতে। এ নিয়ে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিসহ  নানা অভিযোগও শোনা গেছে। রাশিয়ার সঙ্গে আগামীতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। এও সত্য, দেশ-বিদেশে বিপুল বিতর্ক সত্ত্বেও কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুতের দাম তুলনামূলকভাবে কম। অবশ্য ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী রামপালের বিদ্যুতের দাম আদৌ কম পড়বে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কেননা স্থানীয় বড়পুকুরিয়ায় প্রাপ্ত কয়লা যেখানে প্রতি টন মাত্র ৮৪-৮৫ ডলারে বিক্রি হয়, সেখানে রামপালের কেন্দ্রটির জন্য ভারত থেকে কয়লা আমদানি করতে হবে প্রতি টন ১৭৩ ডলারে। তারপরও এ প্রকল্পে ভারত সরকার যে অর্থ ব্যয় করবে, বাংলাদেশকে সে জন্য ১৪ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। হিসাব মতে, প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ পড়বে ১৫ কোটি টাকা। এতে যৌথভাবে বিনিয়োগ করেও বাংলাদেশের লাভের চেয়ে ক্ষতির আশঙ্কাই বিশেষজ্ঞদের। তার মানে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত বিদ্যুতের দামও পড়বে অনেক বেশি। অনেকটা ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মতোই। এদিকে আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল, বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানসহ ১২ জন বিশিষ্ট নাগরিক রামপালে বিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের উদ্যোগ বাতিলের আহ্বান জানিয়ে এক বিবৃতি দিয়েছেন। তারা বলেছেন, বনের পাশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হবে। তাহলে কি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্ভবনা না সংকট এই প্রশ্ন সবার।
সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সুন্দরবন সংলগ্ন বিদ্যুত কেন্দ্রটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য হস্তক্ষেপ জরুরি। কেন্দ্রটি স্থানীয় পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের কোনো ক্ষতি করবে না, এমন কোনো স্থানে অবিলম্বে সরিয়ে নেওয়া হোক। কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপনের বিষয়েও সরকারকে পরিবেশের কথা মাথায় রেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার । 

No comments:

Post a Comment