Thursday, June 14, 2012

বিদ্যুৎ বিলের স্ল্যাব প্রথা বাতিল ন্যায়ের পরিপন্থী

বিদ্যুৎ বিলের স্ল্যাব প্রথা বাতিল ন্যায়ের পরিপন্থী
- ডক্টর তুহিন মালিক


প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহের সামর্থ্য না থাকলেও গ্রাহকদের ওপর একেরপর এক মূল্যবৃদ্ধির বোঝা চাপাতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জুড়ি নেই। এর পরও রয়েছে ভুতুড়ে বিলের অত্যাচার। অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিলের এ নিগ্রহ ভোগ করছেন লাখ লাখ গ্রাহক। একসঙ্গে কয়েকগুণ বিদ্যুৎ বিল বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা তা পরিশোধ করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।
দেশে বিদ্যুৎব্যবস্থা চালুর পর থেকে স্ল্যাবভিত্তিক বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের সুযোগ ছিল। কিন্তু গত মার্চ থেকে স্ল্যাব প্রথা তুলে দেওয়া হয়েছে। ফলে হঠাৎ বিদ্যুৎ বিল বেড়ে তিনগুণ পর্যন্ত হয়েছে। আকস্মিক এই বাড়তি বিল পেয়ে মহাবিপাকে পড়েছেন সাধারণ গ্রাহক। বাড়তি বিদ্যুৎ বিল অবর্ণনীয় দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দিয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তকে। স্ল্যাব প্রথার অন্যতম সুবিধা ছিল, যে যতটুকু বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে তার জন্য স্ল্যাব অনুযায়ী ততটুকু বিল পরিশোধ করতে হতো। এতে গ্রাহকরা বিল পরিশোধে বাড়তি সহায়তা পেতেন। স্ল্যাব প্রথা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। কিন্তু হঠাৎ স্ল্যাব প্রথা তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকারের শীর্ষ মহল। আর এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে জ্বালানি বিভাগের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) বাধ্য করা হয়।

স্ল্যাব প্রথা তুলে দেওয়ায় গ্রাহকভেদে তিনগুণ পর্যন্ত বেড়ে যায় বিদ্যুৎ বিল। শূন্য থেকে ১০০ ইউনিট পর্যন্ত বর্তমানে ৩ টাকা ৫ পয়সা, ১০১ থেকে ৪০০ ইউনিট পর্যন্ত ৪ টাকা ২৯ পয়সা এবং ৪০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী গ্রাহকদের ৭ টাকা ৮৯ পয়সা হারে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয়। অথচ বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে আগের বিধান ছিল, কোনো গ্রাহক ১০১ ইউনিট বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে তিনি ১০০ ইউনিট পর্যন্ত প্রথম স্ল্যাব দরে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতেন। ১০০ ইউনিটের বাড়তি বিদ্যুতের জন্য দ্বিতীয় স্ল্যাব দরে বিল পরিশোধ করতে হতো। অনুরূপভাবে ৪০০ ইউনিটের বেশি কেউ বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে প্রথমে ৪০০ ইউনিটের জন্য দ্বিতীয় স্ল্যাবে এবং অতিরিক্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে বাড়তি বিদ্যুতের জন্য সর্বোচ্চ দর পরিশোধ করতে হতো। কিন্তু স্ল্যাব তুলে দেওয়ায় এ বিল এখন গ্রাহকভেদে তিনগুণ পর্যন্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে।
 বিদ্যুৎ বিভাগের দুর্নীতিবাজদের গাফিলতির কারণে একদিকে যেমন গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, অন্যদিকে সরকারের ভাবমূর্তি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গত সাড়ে তিন বছরে বিদ্যুৎ খাত সরকারের সবচেয়ে বিতর্কিত খাত হিসেবে সমালোচিত হয়েছে। কুইক রেন্টাল সিস্টেমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুঘলকি পরিকল্পনায় শত শত কোটি টাকা অপচয় হয়েছে। সেই সঙ্গে কুইক রেন্টালের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বাংলাদেশ। তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের শরণাপন্ন হওয়ার যৌক্তিকতা অবশ্যই অনস্বীকার্য। কিন্তু এ জন্য একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পেছনে চাহিদা পূরণের চেয়ে কারও কারও পকেটপূর্তির বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে বলেই মনে হয়। কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিণতিতে সরকারকে এখন বিদ্যুৎ ছাড়াই শোধ করতে হচ্ছে হাজার কোটি টাকা। এ পদ্ধতিতে উৎপাদিত বিদ্যুতের খরচ গড়ে দ্বিগুণ অথবা তার চেয়েও বেশি। এ কেন্দ্রগুলো চালু থাকা মানে রাষ্ট্রীয় কোষাগার শূন্য করে ফেলা। এ উপলব্ধির কারণে সরকার এখন বেশির ভাগ কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু তাতেও রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ বন্ধ থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য সরকারকে টাকা ঢালতে হচ্ছে। কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উদ্যোক্তাদের সঙ্গে সরকারের চুক্তি অনুযায়ী সরকার যেমন বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনতে বাধ্য তেমন প্রতি মাসে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং চার্জের নামে প্রতি মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার ওপর ৯ থেকে ৩০ হাজার ডলার ভাড়া দিতে হচ্ছে। ফলে সরকারকে শত শত কোটি টাকা দণ্ডি দিতে হচ্ছে।

আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে এ সমস্যার সমাধানে সুনির্দিষ্ট রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। বলা হয়েছিল, ২০১২ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ সংকটের সমাধান টানা সম্ভব হবে। সে চিত্রকল্প যে হতাশাজনক অবস্থার শিকার হয়েছে, বিদ্যমান সংকট তারই প্রমাণ। বিদ্যুৎ সংকট সরকারের জনপ্রিয়তার জন্য ইতোমধ্যে যে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে সে সত্যটি স্পষ্ট হয়েছে সংসদে বিদ্যুৎ-সম্পর্কিত প্রশ্নোত্তর পর্বে। বিদ্যুৎ সংকটের সমাধানে সরকারের ব্যর্থতা আগামী নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করেছেন সরকারি দলের একাধিক সংসদ সদস্য। শুধু দেশের সাধারণ মানুষই নয় বরং সরকারদলীয় নেতারাও বিদ্যুতের সমস্যা নিয়ে হতাশাগ্রস্ত। স্ল্যাব প্রথা তুলে দেওয়ার ফলে আকস্মিক বাড়তি বিল অবর্ণনীয় দুর্ভোগের দিকে ঠেলে দিয়েছে নিম্ন ও মধ্যবিত্তকে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত ন্যায়ের পরিপন্থী ও জনস্বার্থবিরোধী। এর প্রতিক্রিয়া হবে বহুমুখী। একদিকে ব্যক্তি পর্যায়ে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে, অন্যদিকে জিনিসপত্রের দামও বাড়বে। সরকার ভর্তুকি প্রত্যাহারের নামে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে। তার ওপর স্ল্যাব প্রথা তুলে দেওয়ায় 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' ছাড়া আর কিছু নয়।

জীবনযাত্রার মান বাড়লে বিদ্যুতের ব্যবহারও বাড়বে। বিদ্যুতের ব্যবহার অনুযায়ী পূর্ববর্তী স্ল্যাব প্রথায় মূল্য পরিশোধই হবে ন্যায়ানুগ। গরিব দেশের সাধারণ মানুষের তাদের সামর্থ্য মূল্যে বিদ্যুৎ পাওয়ার অধিকার রয়েছে। শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে গরিবের এ অধিকার হরণ মৌলিক মানবাধিকারেরও পরিপন্থী। সামর্থ্যহীন জনগোষ্ঠীর মৌলিক জীবনধারণের সুবিধা নিশ্চিতকরণের মধ্যেই রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা নিহিত রয়েছে। জনগণের মৌলিক সেবা পাওয়ার অধিকার বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিবেচনা করার কোনো অবকাশ নেই। তাই নতুন এ নিয়ম কোনো বিবেচনায়ই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

২৬ আগষ্ট ২০১২ 

No comments:

Post a Comment