Saturday, May 5, 2012

জলবিদ্যুৎ

জলবিদ্যুৎ


বর্তমান যান্ত্রিক সভ্যতার মূলে রয়েছে শক্তির ব্যবহার। আদিকালে মানুষ পেশীশক্তির উপর নির্ভরশীল ছিল। পরবর্তীকালে মানুষ পশুশক্তিকে বশে এনে কাজে লাগালো। কিন্তু মানুষের প্রকৃত অর্থনৈতিক উন্নতির সূত্রপাত জড়শক্তির ব্যবহার আয়ত্ত করার পর থেকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশে কয়লা ও খনিজ তেলের আবিষ্কারের পর থেকে জড়শক্তির ব্যবহার শুরু হয়। যদিও মানুষ বহু প্রাচীনকাল থেকে কাঠ পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন করছে,বাতাস বা পানির গতির সাহায্যে শস্য ভাঙানোর কাজ করছে।
শক্তি সম্পদরুপে কয়লা ও খনিজ তেলের পরেই জলবিদ্যুতের স্থান। পৃথিবীতে সম্ভাব্য জলবিদ্যুৎ শক্তির (Potential Water Power Resource) পরিমাণ অনেক বেশি। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রাথমিক ব্যয় অপেক্ষা অনেক কম। সে কারণে জলবিদ্যুতের ব্যবহার বিভিন্ন দেশে,বিশেষতঃ উন্নয়নশীল দেশে এখনও বিশেষ প্রসার লাভ করেনি। বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে,নদীর বন্যা নিয়ন্ত্রন জলসেচ ব্যবস্থার প্রবর্তন, ভূমিক্ষয় প্রতিরোধ প্রভৃতি ব্যবস্থা গ্রহণ করার সময় জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়।
বিশ্বব্যাপী স্থাপিত জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের শতকরা ৪০ভাগ উৎপাদন করে এবং প্রায় ১০০ কোটি মানুষকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বিশ্বে সর্বমোট ৬৭৫,০০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়,যা ৩.৬ বিলিয়ন ব্যারেল তেলের সমান। কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই ২০০০ এর বেশি জলবিদ্যুৎ উৎপাদন প্লান্ট আছে, জলবিদ্যুৎ দেশটির সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য শক্তি।
প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ জলশক্তি ব্যবহার করে আসছে। মিশরীয়রা বহু আগেই পানির সাহায্যে চাকা (Water-wheel) ঘুরানোর কৌশল জানত। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের বহু আগে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে পানি প্রবাহের গতির সাহায়্যে চাকা ঘুরিয়ে ময়দাকল, কাঠচেরাই কল ইত্যাদি চালান হত। হিমালয়ের কোন কোন স্থানে এখনও পানির সাহায়্যে চাকা ঘুরিয়ে গম জোয়ার, বাজরা প্রভৃতি শস্য ভাঙানো হয়। এগুলোকে ‘পানি চাক্কি’ বলে। ২০০০ বছর আগে গ্রীকরা গম থেকে আটা তৈরির কাজে পানি চাক্কি ব্যবহার করত বলে জানা যায়। সে পানি চাক্কি অনেকটা এখনকার টার্বাইনের মতই। চাকার গিয়ার গম ভাঙার কাজটি করত। রোমেও জলপ্রবাহের শক্তি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু সহজলভ্য দাস আর পশু শক্তির কারণে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত এর ব্যবহার বিস্তার লাভ করেনি। মধ্যযুগে বড় কাঠের পানি চাক্কি তৈরি হয়। যা থেকে প্রাপ্ত শক্তির পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ অশ্বশক্তি বা হর্স পাওয়ার।
মূলনীতি
জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকৃতির পানি চক্রকে ব্যবহার করে। হিমবাহ, বৃষ্টি, বাষ্প প্রভৃতি অবস্থায় পানি থাকতে পারে। সূর্যের আলোর উত্তাপে বায়ু প্রবাহ সৃষ্টি হয়। কারণ উত্তপ্ত হালকা বায়ু উপরে উঠে গেলে শূন্যস্থান পূরণ করতে সেখানে তুলনামূলকভাবে ভারী শীতল বায়ু চলে আসে। বায়ু প্রবাহ সমুদ্র ও জলাশয়ে পানির বাষ্পীভবন ঘটায় বা ত্বরান্বিত করে। মেঘের সৃষ্টি হয়। আর মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়। যা নদীতে পানি প্রবাহের যোগান দেয়। অবশ্য বরফ গলা নদীও হতে পারে। তবে সেটাও পানি চক্রের অংশ। বৃষ্টিপাত অস্বাভাবিকভাবে কমলে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
নদীর পানি প্রবাহের যে কি বিপুল শক্তি তা এমনিতে অনুমান করা কঠিন। কিন্ত এ পানি যখন একটি সংকীর্ণ পথে প্রবাহিত হয় বা প্রবাহিত করা করা হয় তখন এর শক্তির বিষটি বোঝা যায়।
জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র এ শক্তিকে কিছু সহজ সরল যন্ত্রপাতির সাহায্যে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তরিত করে। এখানে স্থৈতিক শক্তিকে প্রথমে যান্ত্রিক শক্তিতে, তার পরে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তরিত করা হয়। জোয়ার ভাটার শক্তিকে কাজে লাগিয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র মূলত একটি বড় পানি চাক্কি বা water wheel । এর মূল কথা হচ্ছে বাঁধের মধ্য দিয়ে যে পানি প্রবাহিত হয় তা টার্বাইনকে ঘোরায় আর টার্বাইন জেনারেটর ঘোরায়।
পরবর্তীকালে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার বা উদ্ভাবন শক্তির উৎস হিসেবে পানির ভূমিকাকে যথেষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। যে সব আবিষ্কার জলপ্রবাহের শক্তিকে জলবিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তরিত করতে সাহায্য করে সেগুলো হল:
জল টারবাইনের (Hydro or Water Turbine) উদ্ভাবন- এটি একটি উন্নত ধরনের জল চক্র বা পানি চাক্কি, যা উঁচু বাঁধের উপর থেকে পতিত জলপ্রবাহের শক্তিতে ঘুরে থাকে।
ডায়নামোর বা জেনারেটর উদ্ভাবন- পানিবিদ্যুৎ এর ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য বৈদ্যুতিক জেনারেটর উদ্ভাবন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। যা দ্রুত ঘূর্ণায়মান টার্বাইনের সাহায্যে চালিত হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।
সিমেন্টের ব্যবহার- যার ফলে নদীর উপর সুউচ্চ কংক্রিটের বাঁধ নির্মণ সম্ভব হয়েছে, ফলশ্রুতিতে বাঁধের পেছনে বিশাল জলাধার র্সষ্টি করা সম্ভব হয়েছে।
জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাধারণ কিছু অংশ:-
বাঁধ: অধিকাংশ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি ধরে রাখার জন্য বাঁধ তৈরি করা হয়। ফলে বিশাল জলাধার তৈরি হয়। যা বিনোদনের জায়গা হিসেবেও ব্যবহৃত হতে পারে। আমাদের কাপ্তাই লেক এর উদাহরণ।
পানির প্রবেশপথ : অভিকর্ষের কারণে এখান থেকে পানি সুড়ঙ্গপথে টার্বাইনের দিকে অগ্রসর হয়।
টার্বাইন: পানি যখন টার্বাইনের বিশাল ব্লেডে আঘাত করে তখন টার্বাইন ঘুরতে শুরু করে। টার্বাইনের সাথে জেনারেটর সংযুক্ত থাকার কারণে সেটাও ঘুরতে শুরু করে। ফলে বিদুৎ উৎপন্ন হয়। সবচেয়ে প্রচলিত টার্বাইন হচ্ছে ফ্রান্সিস টার্বাইন। যা দেখতে অনেকটা বাঁকানো ব্লেড সমেত চাকতির মত। এর ওজন ১৭২ টন হতে পারে, আর মিনিটে ৯০ বার ঘুরতে পারে।
জেনারেটর: টার্বইন ঘুরতে শুরু করলে জেনারেটরও ঘুরতে শুরু করে। জেনারেটরের বিশাল বিশাল চুম্বক তামার তারের কুন্ডলীর মধ্যে ঘুরতে শুরু করলে বিদ্যুৎ চুম্বকীয় (electromagnetic induction) আবেশ ঘটে,ফলে এসি বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
তারের কুন্ডলীর মধ্যে যখন চুম্বক নাড়ানো হয় তখন চুম্বকের প্রভাবে ইলেকট্রনও তাড়িত হয়। আর ইলেকট্রনের প্রবাহই হচ্ছে বিদ্যুৎ প্রবাহ। কাজেই জেনারেটরে ফ্যারাডের সূত্রানুসারে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়।
যদি একটি তারকে এমনভাবে কোন চুম্বক ক্ষেত্রে নাড়ানো হয় যে সেটি চুম্বক বলরেখা অতিক্রম করে তবে তারটিতে তড়িৎচালক বল বা বিদ্যুৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয়। তারটির প্রান্ত দুটিকে যুক্ত করা হলে সেখানে ততক্ষণ বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবে যতক্ষণ তারটি নাড়ানো হবে। এ নীতি ব্যবহার করে জেনারেটর তৈরি হয়।
অন্যভাবে বললে চুম্বক ইলেকট্রনকে চালিত করে আর ইলেকট্রনের প্রবাহই হল বিদ্যুৎ।
ট্রান্সফরমার বা রুপান্তরক: এই ট্রান্সফরমার প্রাপ্ত এসি বিদ্যুৎ প্রবাহকে উচ্চ ভোল্টেজের বিদ্যুৎ প্রবাহে রুপান্তরিত করে। দূরে পাঠানোর জন্য উচ্চবিভব উপযুক্ত কারণ তাতে অপচয় কম।
সরবরাহ লাইন: প্রতিটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে চারটি তার বের হয়। একটি গ্রাউন্ড বা কমন আর বাকি তিনটি তার তিনটি ফেজের বা দশার জন্য,যা একই সাথে উৎপন্ন হয়।
নির্গমণ পথ: এ পথে পানি পুনরায় মূল প্রবাহে ফিরে যায়।
জলাধারের পানিকে সঞ্চিত শক্তির সাথে তুলনা করা যায়। যখন সুড়ঙ্গ পথ উন্মুক্ত করা হয় হয় তখন পানি টার্বাইনের দিকে অগ্রসর হয়, এর গতির কারণে এটি গতিশক্তি অর্জন করে।
উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে।
১. প্রবাহিত পানির আয়তন
২. টার্বাইন হতে পানি পৃষ্ঠের দূরত্ব
তবে কিছু কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি জলাধার ব্যবহার করে। একটি ওপরে, আরেকটি নিচে। ওপরেরটি থেকে সাধারণভাবে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। কিন্তু ব্যবহৃত পানি নদীর মূল প্রবাহে না দিয়ে নিচের জলাধারে পাঠানো হয়। অফপিক আওয়ারে সেখানে বিপরীত টার্বাইন ব্যবহার করে পানিকে ওপরের জলাধারে নিয়ে আসা হয়। এধরনের প্লান্ট হতে পিক আওয়ারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বেশি পানি পাওয়া সম্ভব হয়।
জলবিদ্যুৎ সারা বিশ্বে
২০০২ সালে বিশ্বব্যাপী মোট উৎপাদিত শক্তির ১৭ ভাগ ছিল জলবিদ্যুৎ। আর নরওয়ের মোট উৎপাদিত শক্তির ৯৯ ভাগ জলবিদ্যুৎ। কঙ্গো ১০০ ভাগ, ব্রাজিল ৮৩ ভাগ। কানাডা ২০০২ সালে ৩১৫.৫ বিলিয়ন কিলোওয়াট ঘন্টা বিদু্ৎ উৎপাদন করেছে।
ব্রাজিল এবং প্যারাগুয়ে যৌথভাবে Itaipu জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে প্রায় ১২,৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
দ্বিতীয় বৃহত্তম জলবিদু্যৎ কেন্দ্র ভেনিজুয়েলার ক্যারনি (Caroni) নদীতে। উৎপাদন ক্ষমতা ১০৩০০ মেগাওয়াট।
গঙ্গা নদীতে জলবিদ্যুৎ প্রাপ্তির সম্ভবনা ১৩ মিলিয়ন কিলোওয়াট। যার ৪০ভাগ ভারতে বাকিটা নেপালে। ভারত এর কিছুটা ব্যবহার শুরু করছে।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের অনুকুল অবস্থা-
বন্ধুর ভূ-প্রকৃতি-
জলস্রোত বেগবতী না হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা অসম্ভব, কারণ জলের গতিবেগ টার্বাইনের চাকা ঘুরিয়ে ডায়নামো মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বন্ধুর ভূ-প্রকৃতির উপর দিয়ে প্রবাহিত নদী খরস্রোতা হয় এবং এর গতিবেগ ও বেশি থাকে। এ কারণে পার্বত্য নদী ও জলপ্রপাত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সহায়ক। এছাড়া সংকীর্ণ পার্বত্য উপত্যকায় বাঁধ নির্মাণ করাও সুবিধাজনক।
নিয়মিত ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত-
নদীতে সারা বছর জলপ্রবাহ থাকা একান্ত প্রয়োজন। সেজন্য প্রয়োজন সারা বৎসরব্যাপী নিয়মিত ও পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত। যেখানে সারাবছর বৃষ্টি হয় না সেখানে র্কত্রিম জলাশয় নির্মাণ করে তার মধ্যে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা হয়। তুষার গলা জলে পুষ্ট নদী জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সহায়ক, কারণ তাতে সারা বছর পানি প্রবাহ থাকে; যেমন, গঙ্গ নদী।
বরফ-মুক্ততা-
তাপমাত্রা হিমাঙ্কের নিচে নেমে গেলে পানি বরফে পরিণত হয় এবং তখন তা হতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়। কাজেই বরফ-মুক্ততাও জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি অত্যাবশ্যক পূবশর্ত। আমেরিকা যক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত নায়গ্রা জলপ্রপাত শীতকালে জমে যায় বলে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হয়।
বনভূমি-
জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে বনভূমিরও কিছুটা (পরোক্ষ) প্রভাব আছে। প্রথমতঃ বনভূমি জলপ্রবাহ ও বৃষ্টিপাত নিয়ন্ত্রণ করে এবং দ্বিতীয়তঃ এটি ভূমিক্ষয় প্রতিরোধ করে। অধিক ভূমিক্ষয়ের ফলে নদীর পানি যদি অত্যধিক পলিযুক্ত হয় তবে বাঁধের পশ্চাতে নির্মিত জলাধার শীঘ্রই পলি জমে ভরাট হয়ে যাবে। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের যন্ত্রাদিও পলি জমার ফলে শীঘ্রই নষ্ট হয়ে যাবে। সুতরাং জল অধিক পলিযুক্ত না হওয়াই শ্রেয়।
কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র
কাপ্তাইয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। যা বন্দর নগরী চট্রগ্রাম থেকে প্রায় ৫০ কিমি দূরে অবস্থিত। কর্ণফুলী বহুমুখী প্রকল্পের অংশ হিসেবে ১৯৬২ সালে এটি তৈরি করা হয়। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প। ১৯৬২ সালে চালুর সময় এটি জাতীয় গ্রীডে ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারত। পরবর্তী বছরগুলোতে এর উৎপাদন ক্ষমতা বাড়িয়ে ২৩০ মেগাওয়াট করা হয়। এ প্রকল্প শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনেই নয় নিম্নাঞ্চলে বন্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখছে।
জলবিদ্যুৎ শক্তি ও তার সুবিধা-অসুবিধা
শুরুতে জলবিদ্যুৎ পরিচ্ছন্ন শক্তি বা ক্লিন এনার্জি মনে করা হলেও এখন আর তা মনে করা হচ্ছে না। এর পক্ষে বিপক্ষে নানা কথা এখন বলা হয়।
জলবিদ্যুৎ শক্তির ভান্ডার অফুরন্ত এবং এটি সাশ্রয়ী। যতদিন সূর্যতাপে পানি বাষ্পীভূত হয়ে পৃথিবীতে বৃষ্টিপাত ঘটাবে ততদিন জলবিদ্যুতের সরবরাহ অফুরন্ত থাকবে। প্রতি অশ্বশক্তি জলবিদ্যুৎ মানেই ৪ মেট্রিক টন কয়লার সঞ্চয়। অল্প সংখ্যক জনবল দ্বারা এটি চালানো যায়। সাধারণত একটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র দীর্ঘদিন বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে।
তবে এটি তৈরি ব্যয়বহুল, তেল গ্যাস কাছে পাওয়া গেলে অর্থাৎ সহজলভ্য হলে এরং ব্যবহার অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক হয় না। যদিও জলবিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কম।
জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তুসংস্থানের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, মাছের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। কারণ বাঁধের কারণে মাছসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণীর চলাচল ব্যাহত হয়।
টার্বাইন থেকে বের হওয়া পানিতে পলির পরিমাণ কম থাকে। ফলে নিম্নাঞ্চলে ভাঙন দেখা দিতে পারে। আর উজানে পলি জমে ভরাট হতে পারে। একারণে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর এ ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। যেমন কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ ৯০ বছর। পানি প্রবাহের যথেষ্ট হ্রাসবৃদ্ধি ঘটাতে হয় ফলে নিম্নাঞ্চলে ভাঙন বৃদ্ধি পায়। এছাড়া এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করলে পানিতে অক্সিজেনের  পরিমাণ ও যথেষ্ট ওঠানামা করে। বাঁধ থেকে বের হওয়া পানির তাপমাত্রা উজানের পানির চেয়ে যথেষ্ট কম হয়। সেটাও বিভিন্ন জলজ প্রজাতির জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে।
উষ্ণ এলাকার জলাধারগুলো যথেষ্ট পরিমাণে মিথেন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড উৎপাদন করে যা গ্রীন হাউস প্রভাব বৃদ্ধিতে ভুমিকা রাখে। প্লাবিত এলাকার উদ্ভিদকুলের পচন এর জন্য দায়ী। টার্বাইনের মধ্য দিয়ে পানি নিঃসরণের সময় মিথেন নির্গত হয়। ওয়ার্ল্ড কমিশন অন ড্যাম এর রিপোর্ট অনুযায়ী যেখানে উৎপাদন ক্ষমতার তুলনায় জলাধার বেশ বড় (প্রতি বর্গমিটারে ১০০ ওয়াটের চেয়ে কম) সেখানে যদি জলাধার সৃষ্টির আগে বনাঞ্চল পরিষ্কার না করা হয়ে থাকে তবে সেখানে গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ প্রচলিত তেল চালিত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে বেশি।
অনেক মানুষকে পুনর্বাসিত করতে হয়। ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা পনির নিচে চলে যেতে পারে। যা একটি অঞ্চলের মানুষের জন্য যথেষ্ট মনঃকষ্টের কারণ হতে পারে। কাপ্তাই লেক তৈরি হলে সে সময় পার্বত্য চট্রগ্রাম এলাকার একমাত্র দ্বিতল ভবন চাকমা রাজবাড়ী পানির নিচে তলিয়ে যায়। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হলে ১৮,০০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সে জায়গা সরকারের হলেও মানবিক কারণে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল কিন্তু অভিযোগ রয়েছে সবাই ক্ষতিপূরণ পায়নি। পানিপথে যাতায়াত সহজ হওয়াতে বনজ সম্পদ চুরি বেড়েছে, দূষণ বেড়েছে।
March 28, 2012

No comments:

Post a Comment