Thursday, May 3, 2012

জেনারেটর ব্যবহারে বেড়ে যাচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়

জেনারেটর ব্যবহারে বেড়ে যাচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়

আতাউর রহমান কাবুল
বিদ্যুত্ সঙ্কটে স্থবির হয়ে পড়েছে ব্যবসা-বাণিজ্য। সন্ধ্যার পর সরকারের এসি চালানো বন্ধের পদক্ষেপেও উন্নতি হচ্ছে না বিদ্যুত্ পরিস্থিতির। সঙ্কট মোকাবিলায় জেনারেটর ব্যবহারে একদিকে শিল্প উত্পাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে বেড়ে যাচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। ফ্ল্যাট বাড়িসহ মহল্লায় মহল্লায় জেনারেটর ব্যবহারের জন্য দিতে হচ্ছে বাড়তি খরচ। এতে বেড়ে যাচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। নিরবচ্ছিন্নভাবে পাম্প চালানো সম্ভব না হওয়ায় রাজধানীর সর্বত্র চলছে পানির জন্য হাহাকার। এ সমস্যার সঙ্গে যোগ হয়েছে গ্যাস সমস্যা। নতুন সংযোগ বন্ধ রেখেও সামাল দেয়া যাচ্ছে না গ্যাস সমস্যা।
গত ক’দিনে বিদ্যুত্ পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ও প্রচণ্ড গরমে দেশের মানুষের সার্বিক জীবন বিপর্যস্ত। রাজধানীতে প্রতিদিন লোডশেডিংজনিত বিদ্যুত্ পরিস্থিতিও নাজুক। তবে রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ এলাকা বিদ্যুিবহীন থাকলেও বিদ্যুত্-গ্যাস-পানি সঙ্কটের মারাত্মক শিকার মানিকনগর, গোরান, মুগদা, মাণ্ডা, মাদারটেক, খিলগাঁও ও ডেমরা এলাকার লোকজন। গতকাল সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, এসব এলাকায় বিদ্যুত্ আসা মানে আকাশে চাঁদ দেখা। বিদ্যুিবহীন অসহ্য গরম ও মশার যন্ত্রণায় সারারাত এক রকম নির্ঘুম কেটে রাত ৩টায় এসব এলাকার গৃহিণীরা রান্নার উদ্দেশ্যে চুলা জ্বালান। রাত ৩টার পর এসব এলাকার চুলাতে গ্যাস আসে। এসব এলাকায় বিদ্যুত্ আধা ঘণ্টা থাকলেও আড়াই ঘণ্টা থাকে না। এলাকায় সরবরাহকৃত পানি দুর্গন্ধযুক্ত। এ পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে শিশুরা। শিশুদের ঘুম পাড়াতে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে মায়েদের অবস্থা বেগতিক। পরিস্থিতি মোকাবিলায় মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা ব্যবহার করছেন জেনারেটর। এতে বেড়ে যাচ্ছে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয়। বাসাবো সিনেমাহলের পাশের পাম্পে দিনরাত প্রায় ২৪ ঘণ্টাই লম্বা লাইন দিয়ে মহিলারা পানি সংগ্রহ করেন। জমিলা খাতুন নামে পঞ্চাশোর্ধ্ব এক মহিলা জানালেন, তিনি অনেক দূর থেকে এসেছেন পানি নিতে। এক কলসি পানি রিকশাভ্যানে করে বাসায় নিয়ে যেতে ৫০-৬০ টাকা খরচ হয়ে যায়।
গুলশানের গৃহিণী সিতারা বেগম জানালেন. তাদের বাসার ৩টা ফ্ল্যাটের জন্য বিদ্যুতের বিকল্প ব্যাকআপ রাখতে জেনারেটর রাখা হয়েছে। এতে প্রতি মাসে অতিরিক্ত ৬০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। এখানে দু’ থেকে তিন ঘণ্টা পরপর বিদ্যুত্ আসে।
ধানমন্ডিতে অবস্থিত কিডনি ফাউন্ডেশন নামক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানেও শুধু জেনারেটর বাবদ প্রতি মাসে ২ লাখ টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। এরপরও ব্যাকআপ নিতে না পারায় মাঝে মাঝে জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেলে কিডনি অকেজো রোগীদের চিকিত্সায় বিরাট সমস্যা হয় বলে জানালেন প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক টিনি ফেরদৌস রশিদ।
হাতিরপুলের ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের বাসিন্দা সুমন জানালেন, তাদের এলাকায় এর আগে পানির তেমন সঙ্কট না থাকলেও ইদানীং পানিতে তীব্র গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। বিদ্যুতের পাশাপাশি এসব এলাকাসহ ধানমন্ডিতে গ্যাসেরও তীব্র সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। এখানকার চুলা নিবুনিবু করে জ্বলে।
মতিঝিলের এক কম্পিউটার প্রতিষ্ঠানের হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার তারেক জানালেন, বিদ্যুত্ সমস্যার কারণে তাদের দোকানে দিনে একটি পিসিও বিক্রি হচ্ছে না। একটি পিসি এসেমব্লিং করতে সারাদিন চলে যায়। মার্কেটে ক্রেতার সংখ্যাও অনেক কমে গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিদ্যুত্ সঙ্কটের কারণে বিভিন্ন সফটওয়্যার কোম্পানিতে কর্মরত সফটওয়্যার প্রকৌশলীরা ডেভেলপের কাজ করতে পারছেন না। যারা বিদেশে আউটসোর্সিংয়ের কাজ করছেন তারা ঠিকমত কাজ ডেলিভারি দিতে পারছেন না। জাপানে আউটসোর্সিং করছেন এমন একটি প্রতিষ্ঠানের সিইও সাজেদুর রহমান জানালেন, কাজ ঠিকমত ডেলিভারি না দিতে পারায় গত সপ্তাহে তাদের সফটওয়্যার আউটসোর্সিং সংক্রান্ত এ চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে। এরই মধ্যে তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মী ছাঁটাই করাও হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটটি শিক্ষার্থীসহ অনেকেরই প্রিয়। স্বল্পমূল্যে এখানে বইকেনা, কম্পিউটার কম্পোজ, প্রিন্ট ও ফটোকপি করা যায়। বর্তমানে কম্পিউটারে একটা চিঠি টাইপ করতে সারাদিন লেগে যাচ্ছে। এখানে বিদ্যুত্ ‘এই আছে এই নেই’ অবস্থা। কম্পিউটার প্রিন্ট ও ফটোকপি ব্যবসায়ীরা এক রকম নীরস বসে অস্থির সময় কাটান। একই দৃশ্য দেখা গেল বঙ্গভবন সংলগ্ন ফটোকপি মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে। তারা জানালেন, এই গরম সময়টাতেই ফটোকপির ব্যবসা ভালো চলে। অথচ বিদ্যুত্ না থাকায় ক্রেতাশূন্য অন্ধকার মার্কেটে বসে অস্থির সময় কাটাচ্ছেন তারা।
শিল্পব্যাংক ভবনে অবস্থিত আইসিবি বা ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের ব্রোকার হাউস এতদিন চলত জেনারেটর দিয়ে। কিন্তু ভবন কর্তৃপক্ষের শর্তারোপের কারণে আইসিবি নয় লাখ টাকা খরচ করে আইপিএস কিনেছে সম্প্রতি। এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানালেন, আইপিএস চার্জ হতে যে পরিমাণ বিদ্যুত্ প্রয়োজন তা না পাওয়ায় ব্রোকার হাউস চালাতে তাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
দেশের রফতানি আয়ের অন্যতম উত্স পোশাক খাতে বিদ্যুত্ পরিস্থিতি ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করায় রাজধানীর অধিকাংশ গার্মেন্টে এখন আগের মতো আর উত্পাদন হচ্ছে না। জেনারেটর কিংবা আইপিএস দিয়ে এসব সঙ্কট কাটছে না বলে জানা গেছে।
কাজীপাড়ার রিকশাচালক তুষার আলীর কথা, আমরা রাজনীতি বুঝি না। সরকার যদি বিদ্যুত্ সমস্যা ও শুধু ঢাকা শহরের যানজট সমস্যা নিরসনে কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করত তবে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যেত।
এদিকে গত বৃহস্পতিবার থেকে সারাদেশে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে। অথচ ওই দিনই রাত ৩টা পর্যন্ত বিদ্যুত্ ছিল না রাজধানীসহ দেশের অনেক এলাকায়। এতে পরীক্ষার্থীদের মারাত্মক সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।
সম্প্রতি এক প্রজ্ঞাপনে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সন্ধ্যার পর কোনো এসি চালানো যাবে না। কিন্তু এই নির্দেশ মানা হচ্ছে না খোদ মন্ত্রীপাড়া, সংসদভবনসহ রাজধানীর অভিজাত এলাকায়।
 
 

 

No comments:

Post a Comment