Sunday, May 6, 2012

আধুনিক জীবনের পথ দেখিয়েছে গ্রামীন সৌর বিদ্যুৎ,বায়োগ্যাস ও উন্নত চুলা

আধুনিক জীবনের পথ দেখিয়েছে গ্রামীন সৌর বিদ্যুৎ,বায়োগ্যাস ও উন্নত চুলা 

নওগাঁর ঠাঁঠা বরেন্দ্র এলাকা সাপাহারে সৌর বিদ্যুৎ দ্বারা গভীর নলকুপ চালিয়ে ফসলের জমিতে সেচ কার্যক্রম সহজ হওয়ায় পাশাপাশি অজপাড়া গাঁয়ের জনপদে সৌর বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত করা, বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপন ও উন্নত চুলার প্রযুক্তি ব্যাবহার আধুনিক জীবন যাত্রার মান বৃদ্ধি করে সকল শ্রেণী পেশার মানুষের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। উপজেলার আইহাই ইউনিয়নের আশড়ন্দ বাজারের পার্শ্বের মাঠে গ্রামীণ শক্তি সোলার ইরিগেশন প্রকল্পের আওতায় গত বছর স্থাপন করা হয়েছে সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে চালিত সেচ প্রকল্প। ওই প্রকল্পে বাংলাদেশে এই প্রথম বারের মতো সৌর বিদ্যুৎ প্রযুক্তি ব্যবহার করে গভীর নলকুপ চালিয়ে মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলন করে গত বছর প্রাথমিক ভাবে প্রায় ২৫ বিঘা বোরো ধানের জমিতে স্বাভাবিক ভাবে সেচ প্রদান করে চাষাবাদ করা হয়েছিল । চলতি বছর রবি মৌসুমে এ প্রকল্পের অধিনে প্রায় ১২০বিঘা জমিতে গম ,সরিষা, আলু, পিয়াঁজ সহ বিভিন্ন সবজি চাষাবাদ করা হয়। বর্তমান আমন মৌসুমে সম পরিমাণের জমিতে আমন ধান চাষাবাদ করা হয়েছে।

সাপাহার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোছাঃ রাহেলা পারভীন জানান, উপজেলায় বর্তমানে বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ৩১১ টি বিদ্যুৎ চালিত গভীর নলকুপ চালু রয়েছে । যার মধ্যে ১ ফসলি জমির পরিমাণ-৩,৯৭০ হেক্টর, ২ ফসলি জমি- ৯,০০৫হেক্টর ,এবং ৩ ফসলি জমির পরিমাণ- ৬,৯১৫ হেক্টর। এখানে নিট ফসলি জমির পরিমান-১৯,৮৯০হেক্টর, শুধু মাত্র পানি সেচ ব্যবস্থা না থাকার কারণে প্রায়- ৪,৫০০হেক্টর জমি সম্পূর্ণ অনাবাদী অবস্থায় পড়ে থাকে। সরকারী বা বে-সরকারী উদ্যোগে ওই এলাকা সমুহে যদি সোলার চালিত ডীপ টিউবওয়েল স্থাপন করা হয় তাহলে দেশের বিদ্যুৎ স্বাশ্রয় হবে। পাশাপাশি পতিত জমিতে প্রতি মৌসুমে বিপুল ফসল উৎপন্ন হলে দেশ খাদ্য স্বয়ং সম্পূর্ণ হবে। এতে ঠাঁঠা বরেন্দ্র এলাকার কঠিন মাটির বুকে গড়ে উঠবে সবুজের সমারহ।

উপজেলার উপ-সহকারী কৃষি অফিসার জাহিদুল হক জানান , সোলার চালিত পাম্প দিয়ে ধানের চেয়ে রবি শষ্য উৎপাদন করাই সহজ হয়। কারণ যে সময় বোরো জমি ভিজানো হয় তখন আকাশ কুয়াশার চাদরে ঢাকা তাকে সুর্য্য দেখা যায় না। রোদ না থাকলে সোলারে বিদ্যূৎ উৎপন্ন হয় না। অপর দিকে রবি শষ্য বোপনের সময় সর্বক্ষন প্রখর রোদ বিরাজ করে এতে বিদ্যূৎ এর কোন সমস্যা হয় না।

স্থানীয় গ্রামীণ শক্তির ম্যানেজার মিলাদুর রহমান মিলন ও পাম্প ইন্চার্জ সন্তোষ রায় জানিয়েছেন এখানে সৌর বিদ্যুতের মোট ৬৪টি প্যানেল বসানো হয়েছে। যার প্রতিটি প্যানেল থেকে ১৭৫ ওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব। এখানে উৎপাদিত মোট ১১ হাজার ২শ ওয়াট বিদ্যুৎ দ্বারা মোট ৬৫ বিঘা ধানের জমিতে সেচ কার্যক্রম সম্পাদন করা সম্ভব। তবে এতে ঝুকি হতে পারে তাই ধানের পরিবর্তে কম সেচ প্রয়োজন এমন ফসল তিনগুন জমিতে চাষাবাদ করা যাবে। এ ধারনা থেকেই সেচ প্রকল্পের আওতাধীন চাষীরা এবারে গম ,সরিষা আলু, পিয়াঁজ, শাক-সব্জির চাষাবাদ করে কম সেচের মাধ্যমে অধিক মুনাফা অর্জন করে লাভবান হয়েছে। 

গ্রামীন শক্তির রিজিওনাল ম্যানেজার মোঃ আব্দুল ওয়াহাব  জানিয়েছেন, গ্রামীণ পরিবার ভুক্ত একটি প্রতিষ্ঠান হলো গ্রামীণ শক্তি, সূর্যের আলো হতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যবস্থা (সৌরবিদ্যুৎ সিস্টেম) বিক্রি ও স্থাপন করে গ্রামীণ জন পদের মানুষের মাঝে বিদ্যুৎ এর বিকল্প সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে। সৌর বিদ্যুতের মাধ্যেমে বিভিন্ন ধরণের বৈদ্যুতিক সামগ্রী চালানো যায়। যেমন- সাদাকালো টিভি, রেডিও, সেলুলার ফোন, ডিসি সোল্ডারিং আইরন, কম্পিউটার এবং মোবাইল চার্জ করা যায়। সাপাহার উপজেলার প্রায় ৫ হাজার পরিবার সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার করে উপরোক্ত সুবিধাগুলি পাচ্ছে। এই সিস্টেমে লোডসেডিং নেই, মাসিক বিল ও জ্বালানী খরচ নেই, একে কমপক্ষে বিশ বছর নিশ্চিন্তে ব্যবহার করা যাবে। প্রয়োজনে সিস্টেমটি স্থানান্তর করায় কোন সমস্যা হয় না । এ ছাড়া গ্রামীণ শক্তির আর একটি কাজ সর্ব মহলে বেশ প্রসংশিত হয়েছে তা হলো। বায়োগ্যাস প্রযুক্তি ব্যবহার। বায়োগ্যাসের সরি দ্বারা উৎপাদিত জৈব সার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করছে। মাছের খাবার হিসাবে সরি ব্যবহার করে মৎস্য চাষে লাভবান হচ্ছে। বায়োগ্যাস হতে নির্গত বায়োসরি উন্নত মানের জৈব সার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ সার ব্যবহার করে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শতকরা ৩০-৪০ ভাগ কৃষকেরা কমিয়েছে। গাছের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান ছাড়াও এ সার মাটির ভৌতিক এবং জৈবিক গুণাবলীর অভূত উন্নয়ন করে থাকছে।

গ্রামীণ শক্তি পরিবেশ বান্ধব উন্নত চুলা প্রযুক্তি বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রসারণ করেছে। বর্তমানে দেশের প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ পরিবার রান্না-বান্না ও অন্যান্য কাজে প্রচলিত চুলা ব্যবহার করে। গবেষনাগারে পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে যে, উক্ত চুলায় জ্বালানি পুড়িয়ে যতটুকু তাপশক্তি পাওয়া যায়, তার প্রায় শতকরা ৫-১৫ ভাগ কাজে লাগে এবং বাকি শতকরা ৮৫ থেকে ৯৫ ভাগ অহেতুক অপচয় ঘটে। অন্য দিকে, এই চুলার সৃষ্ট গরম বিষাক্ত গ্যাস, অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ করে এবং ব্যবহারকারী নানান অসুখ বিসুখ যেমন, মাথা ধরা, সর্দি-কাশি, শ্বাস কষ্ট, বিভিন্ন রকমের চোখের অসুখ, ক্ষুদা-মন্দা, ইনসোমনিয়া, ফুসফুস জনিত রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদি এমনকি ক্যানসারের মত মারাত্মক ব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারেন। উন্নত চুলা ব্যবহারের সুবিধা -অভ্যন্তরীণ বায়ু দূষণ রোধ করে এবং ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্য ভাল থাকে। শতকরা ৫০-৬০ ভাগ জ্বালানি সাশ্রয় করা সম্ভব। কম সময়ে রান্না করা সম্ভব। রান্না ঘরে ধোঁয়া ও কালী হয় না। হাড়ি-পাতিল ময়লা হয় না। অগ্নি দূর্ঘটনা কম হয়। খাবারের মান অটুট থাকে। পরিবেশ ও বনজ সম্পদ সংরক্ষণে সাহায্য করে। সর্বোপরি বায়ুমন্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ হ্রাস পায় বিধায় “গ্রীন হাউজ এফেক্ট” কমাতে সাহায্য করে।

সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে ,এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে মোট ব্যয় হয়েছে ৫০ লাখ টাকা যার মধ্যে ২০ লাখ টাকা ভতুর্কি প্রদান করেছে ইডকোল কোম্পানী। প্রতিদিন সকালে সূর্য উদয়ের পর হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কিরণ ব্যবহার করে এই প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সেচ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।

উপজেলা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সহকারী প্রকৌশলী জনাব মোঃ মতিউর রহমান  এ প্রসঙ্গে বলেন, যে এই সেচ প্রকল্পটি কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে বিশেষ ভাবে সহায়তা করছে । ইতোপুর্বে ওই ১২০ বিঘা জমিতে বছরে ১টি করে ফসল (শুধু আমন ধান) চাষ হত। আর এখন বছরে এই জমিতে ২-৩ বার ধান, গম, ও অন্যান্য শাক সব্জি চাষ করা সম্ভব হচ্ছে। উক্ত সোলার পাম্পের আশপাশে প্রায় ১২০ বিঘা চাষ যোগ্য জমি আছে এবং সেই ১২০ বিঘা জমির মালিকে নিয়ে ২১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কৃষক কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর বর্তমান সভাপতি মো: আলাউদ্দীন জানান, এলাকার দরীদ্র কৃষক জমির উদ্দিন, তমিজ উদ্দিন, আলাউদ্দিন, খাইরুল ইসলাম, মোঃ ঝড়া মিয়া, মোঃ জবদুল, শাজাহান, আফজাল, মজিবর, দুরুল হোদা হাজী, বাবু, ফিরোজ, মিজানুর, জিলুর রহমান মোজাম্মেল, ছাইদুল রহমান , কিসমত আলী ,মো: শফিউদ্দিন, মাহবুব আলম, মো: খলিল ও মো: মোশারফ হোসেন বিদ্যুৎ সহ ওই এলাকার অন্য কৃষকগণ সোলার ডিপ হতে নিয়মিত পানি নিয়ে স্থাপনের পর হতে প্রায় ১২০ বিঘা জমিতে  রোপা আমন, আউস, বোরো ধান সহ গম, সরিষা, আলু, পিয়াঁজ, শাক সবজি চাষ করে নিজেদের ভাগ্যের উন্নয়ন ঘটিয়ে চলেছেন। কৃষক সভাপতি আরও জানান, বিদ্যুৎ বিল বিষয়ে কৃষকগণ যাতে অল্প খরচে চাষাবাদ করতে পারে সে জন্য রবি মৌসুমে প্রতি মিনিট বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্যে ২ টাকা মিনিট হারে বিল পরিশোধ করতে হবে। যদি কেউ ধান আবাদ করতে চায় তাহলে আলোচনার মাধ্যমে বিল নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। বর্তমানে গ্রামীণ শক্তি এবং কৃষকদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে বিদ্যুতের এই মূল্য ধার্য্য করা হয়েছে। গ্রামীণ শক্তির এ সময় উপযুগী বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্পটি সফল ভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাপাহার উপজেলার অবহেলিত জনপদের হাজার হাজার মানুষ উন্নত ও আধুনিক জীবন যাপনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে ।  

Date: 23th July, 2011

No comments:

Post a Comment