সোলার প্যানেল আইন প্রত্যাহার করা হোক বিদ্যুৎ
আজ আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা আকারে দেখা দিয়েছে। গত পাঁচ বছর শত
চেষ্টার পরও বিদ্যুৎ খাতে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারেনি। দেশে বর্তমানে
বিদ্যুতের চাহিদা রয়েছে ১০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। বর্তমানে বিদ্যুতের
উৎপাদন হচ্ছে চার হাজার ৯৯৩ মেগাওয়াট। প্রতিবছর ১০-১৫ শতাংশ হারে
বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। হাজার হাজার শিল্প-কারখানা, ঘরবাড়িতে
বিদ্যুৎ সংযোগ এখনো দেওয়া যায়নি। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পেতে হলে সৌর
বিদ্যুৎ প্যানেল বসাতে হবে। সরকারের এই শর্তে গ্রাহকের কোনো লাভ হচ্ছে না।
প্যানেলের জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করে লাভ হচ্ছে সামান্য। এতে লাভবান হচ্ছেন
ব্যবসায়ীরা। আর সাধারণ গ্রাহক হচ্ছেন ক্ষুব্ধ। আবার গ্রাহক সৌর বিদ্যুৎ
প্যানেল বসালে সরকার যে খুব লাভবান হচ্ছে তা-ও নয়। কারণ যত সংখ্যক প্যানেল
এ পর্যন্ত বসেছে, তা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন এক মেগাওয়াটও বাড়েনি। বরং
সরকারি এই শর্তের সুযোগে অনেক নতুন ব্যবসায়ী প্যানেল ব্যবসা শুরু করেছেন।
তাঁরা নিম্নমানের প্যানেল বেশি দামে বিক্রি করছেন। কেউ আবার আগ্রহী
গ্রাহকের কাছে মাসিক ভিত্তিতে প্যানেল ভাড়াও দিচ্ছেন। ঢাকা বিদ্যুৎ
কম্পানি_ডেসকো এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কম্পানির (ডিপিডিসি) আওতাধীন
কয়েকটি এলাকায় গ্রাহক, প্যানেল ব্যবসায়ী ও বিদ্যুৎকর্মীদের সঙ্গে কথা
বলে এসব তথ্য জানা গেছে। ঢাকার বাইরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি),
পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ও পশ্চিমাঞ্চল বিদ্যুৎ বিতরণ কম্পানি
(ওজোপাডিকো) সূত্রগুলো থেকে এই রকম তথ্য পাওয়া গেছে। এ অবস্থায় আবাসন
ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাব নতুন বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল
বসানোর শর্ত তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের গবেষণা সংস্থা
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালকের সঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সভায় তারা এ দাবি
জানায়। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎসচিব মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন,
'সৌর বিদ্যুতের প্যানেল স্থাপনের শর্ত বাতিল কিংবা শিথিল করা হবে না। বরং
নতুন করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে গ্রাহকদের জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে
প্যানেলের দাম অনেক কমেছে। কিভাবে সহজে তা পাওয়া যাবে, তাও বিজ্ঞপ্তিতে
বলা হচ্ছে।' বিদ্যুৎসচিব যুক্তি দেন, ২০১৫ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুতের পাঁচ
শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের সরকারি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্যই
এই শর্ত বহাল রাখা দরকার। সরকার জাতীয় গ্রিডের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ
এবং নবায়নযোগ্য উৎসের ব্যবহার বাড়াতে গ্রাহকদের উৎসাহিত করতে নতুন
বিদ্যুৎ সংযোগের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ক্ষমতার সৌর বিদ্যুতের প্যানেল বসানোর
শর্ত আরোপ করেছে। এই শর্তের কারণে নতুন সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকার কিছু
বাড়তি সময় পাচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়ছে। শীতকালও চলে
এসেছে। এ সময় ওই শর্তের বেড়াজালে বিদ্যুতের সংকট কিছুটা নিয়ন্ত্রণে
রাখা হচ্ছে। প্যানেল বসানো গ্রাহকরা লোডশেডিংয়ের সময় কিছু আলো এবং কেউ
কেউ ফ্যান ব্যবহার করতে পারছেন।
গ্রাহকের কথা : ধনী, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ_এ তিন স্তরের গ্রাহকই বলেছেন,
তাঁরা সরকারি শর্তের কারণে বাধ্য হয়ে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল বসিয়েছেন।
এতে অর্থ ব্যয় ছাড়াও অনেক ঝক্কি-ঝামেলা গেছে। কিন্তু লাভ তেমন কিছু হচ্ছে
না। রাজধানীর বাড্ডা থানার সাঁতারকুল ইউনিয়নের পূর্ব পদরদিয়া এলাকার
সাজ্জাদ আলী একটি কাঠ চেরাই কারখানার মালিক। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়ার
আগে তাঁকে প্রায় আট মাস কারখানাটি ডিজেলে চালাতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ১৫
হাজার টাকা ব্যয়ে ৩৭ ওয়াট পিক ক্ষমতার (প্যানেলটি প্রতিদিন একটি সময়ে
সর্বোচ্চ ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ দেবে) একটি প্যানেল তাঁকে বসাতে হয়েছে। তিনি
বলেন, 'এতে কার কী লাভ হয়েছে জানি না। কিন্তু আমি বহু কষ্ট পেয়েছি। কয়েক
মাস থেকেছি শুধু দৌড়ের ওপর। এখন বিদ্যুৎ না থাকলে সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে একটি
লাইট জ্বালিয়ে বসে থাকি। আর কোনো কাজ এতে হয় না।'
একই এলাকার ৭ নম্বর বাড়ির মালিক, অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক এফ এম আমিনুল ইসলাম
বলেন, 'সরকারি শর্তের কারণে সাত লাখ ২০ হাজার টাকায় ১ দশমিক ৮৯ কিলোওয়াট
পিক ক্ষমতার প্যানেল বসিয়েছি। একটি ইনভার্টার (সৌর প্যানেল থেকে পাওয়া
ডিসি বিদ্যুৎকে এসি বিদ্যুতে রূপান্তর করার যন্ত্র) বসিয়ে কিছু লাইট ও
ফ্যান চালাচ্ছি। এক কিলোওয়াট পিকের মতো বিদ্যুৎ পাচ্ছি। যখন লোডশেডিং হয়
তখন কাজে লাগে। সে জন্য এত টাকা ব্যয়ে এই ব্যবস্থার কোনো দরকার ছিল না।'
কলাবাগান লেক সার্কাস এলাকার কয়েকজন বাড়ির মালিকও একই কথা বলেন। তাঁরা আট
থেকে ১৪ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে প্যানেল বসিয়েছেন। তা থেকে পাওয়া
বিদ্যুতে কেউ শুধুই কয়েকটি লাইট জ্বালাচ্ছেন। কেউ কেউ ইনভার্টার স্থাপন
করে কিছু ফ্যান চালাচ্ছেন। লোডশেডিং ছাড়া তাঁদের সৌর বিদ্যুতের কোনো
ব্যবহার নেই।
সংযোগের সংখ্যা কত : এখন পর্যন্ত ডিপিডিসি বিভিন্ন শ্রেণীর প্রায় ১৭ হাজার
গ্রাহককে নতুন সংযোগ দিয়েছে। এদের মোট বিদ্যুৎ চাহিদা প্রায় আট
মেগাওয়াট। এর মধ্যে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল বসাতে হয়েছে প্রায় ৩৫০ জন
গ্রাহককে, যার মোট উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ১৭৫ কিলোওয়াট পিক বা এক
মেগাওয়াটের ছয় ভাগের এক ভাগের মতো। ডেসকো এখন পর্যন্ত নতুন সংযোগ দিয়েছে
প্রায় সাড়ে চার হাজার গ্রাহককে। এর মধ্যে প্যানেল বসিয়েছেন প্রায় ৪০০
জন, যার মোট উৎপাদনক্ষমতা ৪৫০ কিলোওয়াট পিকের মতো। এ ছাড়া পিডিবি, আরইবি ও
ওজোপাডিকোর গ্রাহকরা এখন পর্যন্ত যত প্যানেল বসিয়েছেন, তার সর্বমোট
ক্ষমতাও এক মেগাওয়াটের বেশি হবে না।
নিম্নমানের প্যানেল : পশ্চিম আগারগাঁওয়ে একটি বাড়িতে সৌর বিদ্যুতের
প্যানেল বসানো হয়েছে প্রায় ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে। ক্ষমতা ৪৮ কিলোওয়াট পিক।
৩৫টি লাইট ও ৩৫টি ফ্যান চার ঘণ্টা চলার মতো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার কথা।
এক দিনই তা হয়েছিল। এখন আর হচ্ছে না। ধানমণ্ডি ৪ নম্বর সড়ক ও সেন্ট্রাল
রোডের কয়েক গ্রাহকও বলেছেন, তাঁরা যে ক্ষমতার প্যানেল বসিয়েছেন, সে
অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না। অর্থাৎ তাঁদের নিম্নমানের প্যানেল দেওয়া
হয়েছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
(নবানয়নযোগ্য জ্বালানি) এবং বাংলাদেশ সোলার এনার্জি সোসাইটির সাধারণ
সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ব্যবসায়ী-প্রকৌশলীরা কিছুটা কারসাজি করতে পারেন।
এখন কী করণীয়
১. প্রথমে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এগিয়ে আসতে হবে। হঠাৎ করে
ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে স্থায়ী সমাধান যে হয় না, তা আজ
প্রমাণিত হয়েছে। গত ২৬ নভেম্বর তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর
রক্ষা জাতীয় কমিটির সমাবেশে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন চুক্তিকারীদের
বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। অর্থাৎ ভাড়াভিত্তিক
বিদ্যুৎকেন্দ্র জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাধার মূল কারণ বলে চিহ্নিত। তাই
ক্ষতিকর এই চুক্তিকারীদের বিরুদ্ধে জনতার এই আওয়াজ।
২. অবিলম্বে সোলার স্থাপন বাধ্যতামূলক আদেশ প্রত্যাহার করা উচিত। সোলার
স্থাপনে সরকারি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা ও গুণগত মান নিশ্চিত করা। সোলার
লাগানো হচ্ছে অথচ বিদ্যুৎ সাশ্রয় হচ্ছে না। কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে
সোলার আমদানি করে জাতীয় অর্থের অপচয় করা হচ্ছে।
৩. কয়লাভিত্তিক সাতটি বিভাগে পাঁচ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন
বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা সরকারকে হাতে নিতে হবে। কয়লাভিত্তিক
বিদ্যুৎ শুধু দেশকে রক্ষা নয়, বিদ্যুৎ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের পথ তৈরি
করে।
৪. পুরনো গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে অবিলম্বে আধুনিকীকরণের
উদ্যোগ নিতে হবে। তাতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক থাকবে। বিদ্যুৎ সমস্যা
সমাধানে দেশ এগিয়ে যাবে।
৫. অবিলম্বে গ্যাস তথা জ্বালানি-সংক্রান্ত বিদেশিদের সঙ্গে সম্পাদিত
চুক্তিতে রপ্তানির ধারাটি বাতিল করতে হবে। যেখানে দেশের শিল্প-কারখানা
জ্বালানির অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেখানে কিভাবে রপ্তানির ধারা রাখা যেতে
পারে? বিশেষ করে কনোকো-ফিলিপসের সঙ্গে অসম চুক্তি বাতিল করার উদ্যোগ নেওয়া
উচিত। জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে এ ধরনের চুক্তি জাতির সঙ্গে বেইমানির
শামিল।
৬. সৌর বিদ্যুৎ স্থাপনের পেছনে দুর্নীতির ষড়যন্ত্র কাজ করে বলে বিভিন্ন
মহলে শোনা যাচ্ছে। দলীয় কিছু লোককে সম্পদশালী করার জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ
দেওয়ার ক্ষেত্রে তিন শতাংশ সৌর প্যানেল স্থাপনের বাধ্যবাধকতামূলক আইনটি
করা হয়েছে। দেশের মানুষ এতে কোনো উপকার পাচ্ছে না। শুধু দেশের মানুষের
অর্থের অপচয় করা হচ্ছে। গুটিকতক দলীয় ব্যবসায়ীকে লাভবান করার জন্য এ
ধরনের নীতি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।আবুল কাসেম হায়দারলেখক : প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ও সাবেক সহসভাপতি, এফবিসিসিআইhttp://www.kalerkantho.com
How to Publish a Book | Book Publish Course | 10 Minute School | Playlist
-
*Please Browse this link:*
*How to Publish a Book | Book Publish Course | 10 Minute School |
Playlist*
No comments:
Post a Comment