Thursday, May 3, 2012

জেনারেটর, আইপিএসে দুপচাঁচিয়া আলোকিত

জেনারেটর, আইপিএসে দুপচাঁচিয়া আলোকিত

‘এক-দেড় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকলে দুই-আড়াই ঘণ্টা থাকে না। সারা দিনে যে কতবার বিদ্যুৎ যায়, তা হিসাব করা কঠিন। সবচেয়ে কষ্ট হয় মধ্যরাতে, রাতের ঘুম এখন হারাম হয়ে গেছে। সারা দিন চাকরি করে ঠিকমতো ঘুম না হলে আমরা বাঁচব কেমনে। তারপর আবার রাতে বিদ্যুৎ না থাকায় ছেলেমেয়েদেরও লেখাপড়া নেই বললেই চলে।’ ক্ষোভের সঙ্গে কথাগুলো বললেন উপজেলা সদরের মহিলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মনোয়ারা বেগম।
দুপচাঁচিয়া উপজেলায় বিদ্যুৎবিভ্রাট এখন চরমে। দিনে-রাতে মোট আট-নয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়ায় বিভিন্ন পেশার লোকজন অতিষ্ঠ। বিদ্যুতের এ সংকট পূরণে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী এলাকায় জেনারেটর দিয়ে বিদ্যুতের সরবরাহ করে ব্যবসা চালাচ্ছেন।
উপজেলা বিদ্যুৎ বিতরণ কেন্দ্র (বিউবো) অফিস সূত্রে জানা যায়, এ কেন্দ্রের অধীন পাঁচ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়। তিনটি হিমাগার, দুটি অটো বিস্কুট কারখানা, একটি পেপার মিল, দুটি অটো চালকল, একটি ময়দার কল, সাড়ে ৬০০ চালকল, সাড়ে ৮০০ শ্যালো (অগভীর নলকূপ) ও ডিপটিউবওয়েল (গভীর নলকূপ) এবং সাড়ে ১২ হাজার বাসাবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। এ ছাড়া পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি দুপচাঁচিয়া জোনাল অফিসের অধীনে এক হাজার ২৫০টি শ্যালো ও ডিপটিউবওয়েল, ২৭টি চালকল, দুটি হিমাগার, ২৩ হাজার বাসাবাড়ি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুতের সংযোগ রয়েছে। এ সমিতির আওতায় চার মেগাওয়াট এবং ইরি-বোরো মৌসুমে নয় মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার তেমাথা, পুরোনো বাজার, উপজেলা প্রশাসন মোড়, সিও বাসস্ট্যান্ড, থানা বাসস্ট্যান্ড, মেইন বাসস্ট্যান্ডে নয়-১০টি জেনারেটর এবং উপজেলা সদরের বাইরে তালোড়া বাজার, চৌমহনী বাজার, আলতাফনগর বাজার, সাহারপুকুর বাজার এমনকি গ্রামগঞ্জে জেনারেটর বসিয়ে বাড়ি ও দোকানগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। ওই সব এলাকায় জেনারেটর চালাচ্ছেন সুমঙ্গল চৌধুরী, মোমেন টেইলার্সের মালিক মিজানুর রহমান, আবদুর রহমান, লিড টেইলার্সের মালিক মুনসুর আলী, দুপচাঁচিয়া নিউমার্কেটের মালিক হাজি শামসুদ্দিন, চাতালব্যবসায়ী হাজি ওবায়দুল হক, চেয়ারম্যান মার্কেটের মালিক আবুল হোসেন, রূপ কুমার, নিশি বিকল্প জেনারেটরের মালিক হোসেন আলী। এসব জেনারেটর থেকে প্রায় দুই শতাধিক দোকান ও বাসাবাড়িতে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কিছু কিছু দোকানি ও বাসাবাড়ির লোকজন নিজস্ব জেনারেটর এবং আইপিএস দিয়ে বিদ্যুতের ব্যবস্থা চালু রেখেছেন। জেনারেটর ব্যবসায়ীরা বিদ্যুতের সরবরাহ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা উপার্জন করছেন। কোনো কোনো জেনারেটর ব্যবসায়ী দোকানিদের সংযোগ দিয়ে শুধু বাতি জ্বালিয়ে প্রতিদিন তিন টাকা হারে বিল আদায় করছেন। আবার কোনো কোনো জেনারেটর ব্যবসায়ী বাতি ও ফ্যান চালানোর জন্য প্রতিদিন ১০ টাকা হারে মাসে মাসে বিল আদায় করছেন।
আবার একশ্রেণীর ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল ফোনের দোকানি বাসাবাড়িতে আইপিএস সরবরাহ করে বিদ্যুতের সুবিধা নিচ্ছেন। তবে আইপিএস ব্যবহারকারীরা অভিযোগ করেন, একটি ব্যাটারি এক বছরের বেশি ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। প্রতিবছর নতুন ব্যাটারি ব্যবহার করতে হয়। এ জন্য যাঁরা আইপিএস ব্যবহার করে এ ধরনের অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছেন, পরবর্তী সময়ে তাঁরা আইপিএস অর্ধেক দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
উপজেলায় ঠিকমতো বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু না থাকায় কলকারখানা ও চালকলের উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে পড়েছে। এ জন্য কাগজের কারখানা ও বিস্কুট কারখানার মালিকেরা তাঁদের কারখানায় উৎপাদন অব্যাহত রাখার জন্য নিজস্ব জেনারেটর ব্যবহার করছেন।
উপজেলার উষা ব্রেড অ্যান্ড বিস্কুট কারখানার মালিক দ্বিজেন্দ্রনাথ বসাক বলেন, ‘বিদ্যুতের কারণে কারখানার উৎপাদন কমে গেছে। বিভিন্ন মোকামে চাহিদা মোতাবেক পণ্য পাঠাতে পারছি না। জেনারেটর দিয়ে পণ্য উৎপাদন করতে খরচ পড়ছে বেশি। গ্যাস-সংযোগ কারখানাগুলোর সঙ্গে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে লাভের চেয়ে ক্ষতির হিসাব গুনতে হচ্ছে এখন।’
জেনারেটরের সংযোগ নিয়ে ওষুধ ব্যবসায়ী হাজি ইব্রাহিম আলী বলেন, ‘ঠিকমতো বিদ্যুৎ থাকে না। একদিকে প্রচণ্ড গরম অন্যদিকে বিদ্যুৎ না থাকায় বেচাকেনা কমে গেছে। সন্ধ্যার পর অন্ধকারে ঠিকমতো খরিদ্দারও দোকানে আসতে চায় না। তাই টাকার দিকে না তাকিয়ে বাধ্য হয়ে জেনারেটর থেকে বিদ্যুৎ-সংযোগ নিয়েছি। বিদ্যুতের জন্য মাসে ৭০০-৮০০ টাকা বিলের পাশাপাশি জেনারেটরের জন্য মাসে ৩০০ টাকা অতিরিক্ত বিল দিতে হয়।’
আইপিএস ব্যবহারকারী সোহাগ কম্পিউটার্স সেন্টারের মালিক হারুনুর রশিদ দেওয়ান বলেন, ‘ক্যারেন্ট (বিদ্যুৎ) দিয়্যাই হামাকেরে (আমাদের) ব্যবসা। ক্যারেন্ট না থাকলে খরিদ্দার আসে না। তাই গত বছর আইপিএস লিয়্যা (নিয়ে) এক বছর ভালোই চলল, কিন্তু এ বছর কোনো সার্ভিস দিচ্ছে না। বাধ্য হয়্যা (হয়ে) আবার ছোট একটা জেনারেটর লিছি (নিয়েছি)।’
বাসাবাড়িতে আইপিএস ব্যবহারকারী উপজেলার তেমাথার বাসিন্দা শিক্ষিকা নাহিদ জোয়ারদার বলেন, ‘বিদ্যুতের সমস্যার কারণে কষ্ট করে গত বছর আইপিএস কিনেছি কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই ব্যাটারি নষ্ট হয়ে গেছে। প্রতিবছর ১২-১৩ হাজার টাকা খরচ করে ব্যাটারি কেনা সম্ভব নয়। এভাবে আর কত দিন চলে।’
উপজেলার সিও বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থিত জেনারেটর ব্যবসায়ী আবদুর রহমান বলেন, ‘ক্যারেন্ট (বিদ্যুৎ) না থাকায় গোটা উপজেলা সন্ধ্যার পর অন্ধকার হয়ে যায়। জেনারেটর দিয়ে আমরা উপজেলায় আলো দিয়ে থাকি। তাই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেই জেনারেটর চালু করেছি। বাইরে থেকে লাভ মনে হলেও তেল কিনে, দিনরাত লোক নিয়ে কাজ করে তেমন পোষায় না।’
উপজেলার আবাসিক প্রকৌশলী (আরই) রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘গোটা দেশেই বিদ্যুতের অবস্থা খুব খারাপ। গ্রিডে কর্মরত লোকজনই লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বন্ধ করা না করা তাদের বিষয়। আমাদের হাত-পা বাঁধা। তারপর বিদ্যুতের জন্য গ্রাহকদের এমন কথা শুনতে হয় যে মাঝেমধ্যে মনে হয় চাকরি ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়ি।
বগুড়া পল্লীবিদ্যুৎ সমিতি (পবিস) দুপচাঁচিয়া জোনাল অফিসের উপমহাব্যবস্থাপক সন্তোষ কুমার দাস বলেন, ‘সারা দেশেই বিদ্যুতের বড় ধরনের সমস্যা। গ্রাহকদের চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাচ্ছে না। এর জন্য প্রায় সময়ই গ্রাহকদের কথা শুনতে হয়।’

No comments:

Post a Comment