Saturday, May 5, 2012

সৌর বিদ্যুৎ আশির্বাদ না বোঝা?

সৌর বিদ্যুৎ আশির্বাদ না বোঝা?


ইদানীং দেশে ব্যাপকভাবে সৌর বিদ্যুৎ চালু করার জন্য জোর প্রচারণা শুরু হয়েছে, আইন করে তা চাপিয়ে দেয়াও শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু সৌর বিদ্যুতের প্রযুক্তি ও তার মূল্য বর্তমানে যে পর্যায়ে আছে, এভাবে চাপিয়ে দিলে দেশের জন্য এটি যে একটি বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়াবে সেটি পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্যই এ লিখা। তাছাড়া এটি সম্পূর্ণ পরিবেশ বান্ধবও নয়, যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে চালু সিলিকন ভিত্তিক সৌর বেদ্যুতের প্যানেল সূর্যের বিকিরণের মাত্র ১৫% এর মত ব্যবহার করে। এর ফলে একদিকে অনেকখানি জায়গাও ঢেকে ফেলতে হয়, আবার দামের দিক থেকেও এটি অনেক বেশী- সরকারের ধারণা দেয়া 'সামান্য বেশী' নয়।
প্রথমেই পরিবেশ বান্ধবতার বিষয়টি আলাপ করা যাক।

বেশীরভাগ ব্যবহারে বিদ্যুৎ দরকার হয় রাতে, তাই ব্যাটারীতে শক্তি সঞ্চয় করতে হয়। আর ব্যাটারীতে বিষাক্ত শীসার প্লেট থাকে যা কয়েক বছর পর পর পাল্টাতে হয়। সারা দেশে ব্যাপকভাবে সৌর বিদ্যুৎ চালু করলে ব্যাটারীর শীসা নানাভাবে ছড়িয়ে গড়ে পরিবেশে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তাছাড়া সোলার সেল তৈরী করতেও অনেক শক্তির প্রয়োজন যা পরিবেশ বান্ধবভাবে উৎপাদিত নাও হতে পারে। অবশ্য এটি এ মুহৃর্তে আমাদের চিন্তার বিয়য় নয়, কারণ আমরা সোলার সেল উৎপাদন করি না।

দ্বিতীয়তঃ কোন ধরণের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ না করে গরীব একটি দেশের জনগণের উপর সৌর বিদ্যুৎ এর বিশাল খরচ জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছে সরকার,এটি কোনভাবেই কাম্য নয়। যেসব এলাকা বিদু্যৎ সরবরাহ লাইন থেকে অনেক দূরে, অর্থাৎ গ্রাম, চরাঞ্চল, দূরবতর্ী দ্বীপ, কেবলমাত্র এ সব স্থানেই সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার সমর্থনযোগ্য, কারণ এৰেত্রে বৈদ্যুতিক লাইট, ফ্যান, টিভি ইত্যাদি জীবনের মানের একটি বিশাল পরিবর্তন আনে। এখানে জীবনের মানের উন্নয়নটি অনেক বড়, যা কেবল অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের আওতায় ফেলা য়ায় না। তবে বেশী শক্তি ব্যবহার করা শিল্পের যন্ত্রপাতি বা এয়ার কন্ডিশনার ইত্যাদির জন্য সৌর বদ্যুতের প্রযুক্তি এখনও অর্থনৈতিকভাবে যথাযথ নয়। আর শহরে, যেখানে মেইন বিদ্যুতের লাইন আছে সেখানকার জন্য তো নয়ই। নীচে একটি তুলনামূলক হিসাব তুলে ধরছি। দেখলেই বুঝতে পারবেন দেশের জনগণের বিপুল অর্থব্যবহার করে কেবলমাত্র কিছু ধনী মানুষের বাগান সাজানোর মত উদ্দেশ্য ছাড়া সৌর বিদ্যুৎ বর্তমানে তেমন সুবিধা আমাদেরকে দিতে পারছে না।

আর আমরা যারা শিৰিত জনগোষ্ঠী- তারাও অল্প জেনেই বিশাল আকারে সৌর বিদ্যুতের ব্যবহারের পৰে জোরসোরে আওয়াজ তুলেছি। এটিও খুব দুঃখজনক। কিছুদিন আগে সরকার প্রায় ১০০ মেগাওয়াটের একটি তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে, পত্রিকার খবরে এর খরচ প্রায় এক হাজার কোটি টাকা। যদিও দেশের সামগ্রিক বিদ্যুতের প্রয়োজনের তুলনায় ১০০ মেগাওয়াট বিরাট কিছু নয়, তবুও এই আকারের সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে কত খরচ হবে, দেখা যাক। কিছুদিন আগে সরকারী পর্যায়ে দুটি সৌর বিদ্যুৎ স্থাপনা করা হয়েছে, প্রায় এক কোটি টাকায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রায় বিশ কিলোওয়াট, আর একটি পঁয়ত্রিশ লৰ টাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকে পায় আট কিলোওয়াট। শক্তির হিসেবে প্রথমটির তুলনায় পরেরটিতে কেন প্রায় তিন গুণের বশী খরচ হল তা আমার জানা নেই, তবে স্বল্প খরচের প্রথমটির হিসাব

ধরে নিয়েই বিশেস্নষণটি করছি। আনত্দর্জাতিক বজারমূল্যের সাথেও এর মোটামুটি সামঞ্জস্য আছে। সে হিসাবে ২০ কিলোওয়াটে এক কোটি টাকা লাগলে ১০০ মেগাওয়াটের জন্য লাগবে ৫ হাজার কোটি টাকা। আরও খেয়াল করতে হবে যে এ সৌর স্থাপনাগুলো দিনে গড়পড়তা ৫ ঘন্টার মত বিদু্যৎ সরবরাহ করে থাকে। আর একটি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র দিনে ২৪ ঘন্টাই শক্তি সরবরাহ করতে পারে। সে ভাবে ২৪ ঘন্টা সরবরাহ করতে গেলে ১০০ মেগাওয়াটের সৌর বিদ্যুৎ স্থাপনা একই সাথে লাগবে প্রায় ৫টি, অর্থাৎ লাগবে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ একই ৰমতার তাপবিদু্যৎ কেন্দ্রের খরচের ২৫ গুণ। এটিকে সামান্য বেশী বলাটা ঠিক হচ্ছে কিনা, সরকারকে আবারও ভেবে দেখতে বলছি। আর সাথে সাথে স্বল্প আয়তনের বাংলাদেশের কতখানি ঢেকে ফেলতে হবে তা ভাববার বিষয়। উপরের ৫টি স্থাপনার জন্য ঢাকতে হবে ৩ বর্গকিলোমিটারেরও বেশী। আবার সৌর বিদ্যুতের ব্যাটারীর দাম মোট মুল্যের প্রায় শতকরা ২০ ভাগ,
অর্থাৎ প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা, যা প্রায় প্রতি ৫ বছর পর পর পাল্টাতে হবে।

তার মানে সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি চালু রাখার জন্য প্রতি ৫ বছর পর পর একই ৰমতার ৫টি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনার খরচ করতে হবে। অবশ্য তাপবিদ্যুৎ জেনারেটরে জ্বালানী লাগবে, যা হয় দেশের খনিজ থেকে নেয়া হবে বা বাইরে থেকে আমদানী করতে হবে। জ্বালানী এবং সব রৰণাবেৰণের খরচ ধরেও দেখা যাবে ২০ বছরের ব্যবহারে তাপবিদ্যুতে লাগবে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা, অথচ ২০ বছরের আয়ুসম্পন্ন একই ৰমতার সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হবে প্রথমেই ২৫ হাজার কোটি টাকা, আর পরে ব্যাটারীর জন্য আরও ১৫ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ মোট ৪০ হাজার কোটি টাকা। রৰণাবেৰণের জন্য লাগবে আরও। আর যদি স্বল্প ৰমতাসম্পন্ন বিদ্যুতের কথা বলা হয়, সেৰেত্রে তাপ বিদ্যুৎ জেনারেটর আরও সাশ্রয়ী। ১ মেগাওয়াট ৰমতার তাপ বিদ্যুৎ জেনারেটরের দাম ১ কোটি টাকার মত, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন এসেছে। আর ২৪ ঘন্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে একই সমান ৰমতার সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রাথমিক মূল্যই হবে ২৫০ কোটি টাকা, উপরের হিসাব থেকে ভাগ করে যা পাওয়া যাচ্ছে।

অর্থাৎ ২৫০ গুণ বেশী। ইদানীং দেশে আইন করে দেয়া হয়েছে, ৩ কিলোওয়াট সংযোগে ৯০ ওয়াট সৌর বিদ্যুৎ লাগাতে হবে, অর্থাৎ শতকরা মাত্র ৩ ভাগ। এ সামান্য শক্তি দেশের বিদ্যুতের চাহিদা কতটুকু কমাবে? বিদু্যৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হবার জন্য সরকারী খরচে প্রচারাভিযান চালিয়ে সৌর বিদ্যুতের খরচ থেকে অনেক কমে এর থেকে অনেক বেশী বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যাবে, মানুষের সচেতনতাও বাড়বে। আর যদি সৌর বিদ্যুতের প্রসারে যেতেই হয়, অন্যাই করে বাধ্যকরা কেন? আজকে আমরা সব কিছুতে মুক্ত অর্থনীতি, মুক্ত বাজার বলে জোর আওয়াজ তুলছি, তাহলে এ বিষয়টিকেও মুক্ত রাখা হচ্ছে না কেন? যার ইচ্ছা সে কিনবে। তাই এ আইনটি দেখে মনে হচ্ছে, বিশেষ কারও স্বার্থপুরণের জন্য সরকারকে কেউ কাজে লাগাচ্ছে কি? সরকারকে এজন্য আগে থেকেই সাবধান হয়ে এ বিষয়টি থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ।

আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি, দেশের শিল্প কলকারখানা চালু রাখা বেশী গুরম্নত্বপূর্ণ, যার জন্য ১০০ মেগাওয়াট নয়, এখনই কমপৰে কয়েক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দরকার। সৌর বিদ্যুৎ থেকে এর সমাধান চাইলে যে লৰ কোটি টাকার দরকার হবে তার যোগান এ গরীর দেশ কোত্থেকে দেবে? আর যে মাইলের পর মাইল জায়গা আটকিয়ে ফেলার দরকার হবে তাও এ ছোট দেশে কোথায় পাওয়া যাবে? তাই সৌর বিদ্যুৎ কোনভাবেই দেশের ব্যাপক চাহিদার সমাধান নয়। তা ছাড়া সৌর বিদ্যুতের প্রযুক্তিতে অনেক পরিবর্তন আসছে। প্রায় ৪০% দৰতার সোলার সেল শীগগিরই বাজারে আসছে, তখন বর্তমানের ১৫% দৰতার সৌর বিদ্যুৎ প্যানেল গুলো ফেলে দিতে হবে। তাই শীগগিরই দিন ফুরিয়ে যাওয়া একটি প্রযুক্তিতে গরীব দেশের এত এত টাকা বিনিয়োগ করা উচিত কি? পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রের খরচও সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অনেক কম, যার জন্য পাশের দেশ ভারত, এমনকি তেল ও সূর্যকিরণের অঞ্চল সৌদি আরবসহ অনেক দেশই সেদিকে যাচ্ছে।

পাঠক নিজেই বিচার করে দেখুন গরীব একটি দেশের জন্য সৌর বিদ্যুতের মত এরকম ব্যয়বহুল ব্যবস্থায় যাওয়া যুক্তিযুক্ত কিনা। সরকারের মন্ত্রী মহোদয়গণ বলেছেন যে যারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে বাড়ী বানাচ্ছে তারা আরও কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সৌর বিদ্যুতের কেন ব্যবস্থা করবে না। তারা কেন এ কথাটি বুঝতে পারছেন না যে আপাতঃদৃষ্টিতে ব্যক্তিগত খরচ মনে হলেও শেষ পর্যনত্দ এ খরচ সম্পূর্ণ দেশের। চাইলে আমরা তাদের সে সব টাকা একত্রে সংগ্রহ করে অনেকগুন বেশী ৰমতাসম্পন্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করতে পারি। আর সে জন্য ২৫গুণ বা ২৫০ গুণ বেশী খরচ কেন করব? বরঞ্চ কম খরচে কয়েক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে বাকী টাকা দেশের কৃষি ও নিজস্ব প্রযুক্তি-বির্ভর শিল্প ও কলকারখানায় বিনিয়োগ করে দেশের আয়কে কয়েক বছরের মধ্যেই অনেকগুণে বাড়িয়ে নেয়া সম্ভব, আর সেটিই বুদ্ধিমানের কাজ। দেশে গ্যাস সঙ্কটের কথা বলা হয়, যদি নিজস্ব গ্যাস বা কয়লা একেবারেই না থাকত তাহলে কি আমারা বিদ্যুৎ ব্যবহার করতাম না?

আমদানী করা জ্বালানীও সৌর বিদ্যুতের থেকে অনেক বেশী সাশ্রয়ী। কিছুদিন আগে একটি বিদেশী পত্রিকায় দেখলাম যে তেলের দাম কমে যাওয়ায় পাশ্চাত্যে সৌর বিদ্যুতের বিক্রী কমে গেছে। এর সঙ্গে আমাদের দেশে সরকারের তরফ থেকে জোর করে সৌর বিদ্যুৎ প্রসারের যেন একটি যোগসূত্র খুজে পাচ্ছি। সৌর বিদ্যুতের বিদেশী উৎপাদনকারীদের ব্যবসায় চালু রাখার জন্য আজ তাদের তৃতীয় বিশ্বে এ হানা দেয়া, আর বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশ এসবের খুব সহজ শিকার। এ সব নতুন প্রযুক্তি নিয়ে পরীৰা নিরীৰা করা আমাদের শোভা পায় না। সে সব দেশই তা করতে পারে যাদের দেশের সব মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করেও অনেক উদ্ধুত্ত সঞ্চয় থাকছে। যে দেশের জনগণের প্রায় অর্ধেকের মৌলিক চাহিদার পূরণ হয় নি, সে দেশে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে ব্যাপক আকারে পরীৰা নিরীৰা করাটা কি বুদ্ধিমানের কাজ না বোকামী, পাঠককে ভেবে দেখতে বলছি। তাই ভাবতে হবে- সৌর বিদ্যুৎ আমাদের জন্য আশীর্বাদ না বোঝা?

খোন্দকার সিদ্দিক-ই-রব্বানী
অধ্যাপক, বায়োমেডিকেল ফিজিক্স
এন্ড টেকনোলজি বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Date: September 9, 2011

No comments:

Post a Comment